ইসলাম শান্তির ধর্ম

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমাদের ধর্ম ইসলামের নামকরণও এই সিলম ও সালাম তথা শান্তি শব্দ থেকে। সালামই এ ধর্মের পরিচয় ও নিদর্শন। শান্তিই এর আহ্বান ও পথ-পন্থা। সালামের এ ধর্মই আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন। ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।’ (সূরা মায়িদা : ৩)

ইমাম বোখারি তার সহিহ গ্রন্থে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বাণী সংকলন করেন ‘আল্লাহ তায়ালা আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করে বলেন, যাও অবস্থানরত এসব ফেরেশতাকে সালাম দাও। আর তারা তোমার সালামের উত্তরে কী বলে তা খেয়াল করো। কারণ, তারা যে উত্তর দেবে তা তোমার এবং তোমার সন্তানদের সালামের উত্তর।’ আদম (আ.) গিয়ে তাদের উদ্দেশে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম’। ফেরেশতারা উত্তর দিলেন, ‘আসসালামু আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ।’ সুতরাং সালাম হলো আমাদের পিতা আদম এবং তৎপরবর্তী নবীদের অভিবাদন। এ শব্দেই জান্নাতে ফেরেশতারা মোমিনদের অভিবাদন জানাবেন। এটিই জান্নাতিদের শুভেচ্ছাশব্দ যেদিন তারা তাদের রবের সাক্ষাৎ পাবে। ‘যেদিন আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হবে; সেদিন তাদের অভিবাদন হবে সালাম। তিনি তাদের জন্যে সম্মানজনক পুরস্কার প্রস্তুত রেখেছেন।’ (সূরা আহজাব : ৪৪)।

সালাম শব্দের এই চমৎকার অভিবাদন মানুষের মনে সেতু তৈরি এবং তাদের এক কাতারে আনার অনবদ্য তাৎপর্য ও মহত্তর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে। আল্লাহ তায়ালা এটিকে ঈমানের নিদর্শন ও ইসলাম-অনুসারীর অভিবাদন বানিয়েছেন। মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তোমরা যদি পরস্পরকে না ভালোবাস তাহলে ঈমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদের বলবো না যে, পারস্পরিক ভালোবাসা কোন কাজের মাধ্যমে মজবুত হয়? তোমরা পরস্পর সালামের বিস্তার ঘটাও।’
সালাম হলো আল্লাহর সুন্দরতম নামগুলোর একটি। আল্লাহ নিজে সালাম তথা শান্তি। তাঁর কাছ থেকেই আসে সালাম-শান্তি। তিনি ডাকেন দারুস সালাম তথা শান্তির আলয় জান্নাতে। ‘আর আল্লাহ শান্তি-নিরাপত্তার আলয়ের প্রতি আহ্বান জানান এবং যাকে ইচ্ছা সরলপথ প্রদর্শন করেন।’ (সূরা ইউনুস : ২৫)।

আমাদের ধর্ম ইসলামের নামকরণও এই সিলম ও সালাম তথা শান্তি শব্দ থেকে। সালামই এ ধর্মের পরিচয় ও নিদর্শন। শান্তিই এর আহ্বান ও পথ-পন্থা। সালামের এ ধর্মই আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন। ‘আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।’ (সূরা মায়িদা : ৩)।

সব নবী-রাসূলের সমাপ্তিকারী শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন শান্তি ও সালামের পতাকাবাহী। তাঁর আদর্শ ও সুন্নত ছিল, তিনি নিজের নামাজ শেষ করামাত্র তাঁর উম্মতকে মনে করিয়ে দিতেন, শান্তি আল্লাহর নেয়ামত এবং সেটি প্রত্যাশা ও প্রদান করা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে। এজন্য তিনি সালাম ফিরিয়ে বলতেন : ‘আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম ওয়া মিনকাস সালাম, তাবারাকতা ইয়া যাল-জালালি ওয়াল ইকরাম।’ (অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি শান্তিময়, তোমার কাছ থেকেই শান্তি অবতীর্ণ হয়। তুমি বরকতময়, হে পরাক্রমশালী ও মর্যাদা প্রদানকারী।’ (মুসলিম)।

যে কেউ নবী করিম (সা.) এর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখতে পাবেন, তাঁর দাওয়াতই ছিল শান্তি ও সালামের প্রতি। নবুয়তের আগে-পরে সর্বদাই তাঁর জীবনের প্রধান ও মুখ্য চাওয়া ছিল শান্তি ও সালাম। তিনি জীবনের প্রাথমিক সময়গুলোতেই অংশগ্রহণ করেছিলেন উত্তম চরিত্র, মানুষে মানুষে সম্পর্ক জুড়ে দেওয়া এবং মজলুমের সাহায্যের মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায়। অংশ নিয়েছেন হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠায়। পরবর্তী সময়ে তিনি বলেছেন, ‘আবদুল্লাহ ইবন জাদয়ানের ঘরে আমি এমন এক অঙ্গীকারে (হিলফুল ফুজুলে) অংশ নিয়েছিলাম, যার তুলনায় লাল উটও আমার প্রিয় নয়। ইসলামের (আগমনের) পর আজও যদি আমাকে (এমন কাজে) আহ্বান করা হয়, তবে আমি তাতে সাড়া দিতে তৈরি আছি।’ (বাইহাকি)।

তেমনি নবুওয়তের পরও তাঁর চাওয়া ছিল একটাই দয়া ও কোমলতা, শান্তি ও সালাম। তাঁর আহ্বান ও আকর্ষণ কেবল এসবের প্রতি। ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। বোখারিতে বর্ণিত হয়েছে, ‘হোদায়বিয়া নামক স্থানে গিয়ে নবীজি (সা.) এর উটনী কাসওয়া বসে পড়ল।’ কোরাইশের কাফেররা আল্লাহর রাসুল (সা.) এর ওমরা আদায়ে বাধা হয়ে দাঁড়াল। তিনি তখন বললেন, ‘সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, কোরাইশরা আল্লাহর সম্মানিত বিষয়গুলোর মধ্যে যে কোনো বিষয়ের সম্মান প্রদর্শনার্থে কিছু চাইলে আমি তা পূরণ করব।’ তিনি আরও বললেন, ‘আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি। বরং আমরা এসেছি ওমরা করতে।’ তথাপি কোরাইশরা তাঁকে হারাম শরিফে ঢুকতে বাধা দেয়। তখন তিনি তাদের সঙ্গে একটি সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যা থেকে শান্তি ও সালাম প্রতিষ্ঠায় তাঁর আগ্রহ ফুটে ওঠে। ‘আর যদি তারা সন্ধি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে তুমিও সে দিকেই আগ্রহী হও এবং আল্লাহর ওপর ভরসা কর। নিঃসন্দেহে তিনি শ্রবণকারী; পরিজ্ঞাত।’ (সূরা আনফাল : ৬১)।

নবী (সা.) এর সুরভিত জীবন চাক্ষুস সাক্ষ্য, তিনি যুদ্ধ বা সংঘাতের প্রতি ডাকেননি। ঝগড়া বা বিবাদের দিকে আহ্বান জানাননি। বরং তিনি ছিলেন দয়ার্দ্র, উদার ও ক্ষমাপ্রবণ। মক্কায় দাওয়াতের সূচনাসময়ে যখন তাঁর জাতি তাঁকে অসহ্য যাতনা দিচ্ছে, তাঁর কাছে পাহাড়ের ফেরেশতা এলেন। অনুমতি চাইলেন মক্কার দুই পাহাড়কে মিলিয়ে কোরাইশ কাফেরদের পিষে মারতে। তখন তিনি শান্তি ও সালামই বেছে নেন। বলে ওঠেন : ‘বরং আমি আশা করি আল্লাহ তাদের বংশ থেকে এমন ব্যক্তিদের বের করবেন যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে শরিক করবে না।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর আচরণ শুধু ন্যায়, শান্তি ও দয়ার্দ্রই ছিল না, বরং তা গিয়ে পৌঁছেছিল অনুগ্রহ, মহানুভবত্ব ও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ পর্যায়ে। যেমন বোখারিতে বর্ণিত হয়েছে, এক ইহুদি বালক ছিল যে নবীজি (সা.) এর সেবা করত। সে অসুস্থ হয়ে বিছানাগত হলো। নবী (সা.) তাকে দেখার জন্য গেলেন। তার শিয়রে বসলেন। তার উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘ইসলাম গ্রহণ করো।’ ছেলেটি কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার দিকে চাইল। বাবা বললেন, ‘আবুল কাসেম (সা.) এর অনুসরণ করো।’ ছেলেটি তখন ইসলাম গ্রহণ করল। নবী (সা.) সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন এ কথা বলে, ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করলেন।’ তেমনি মুসনাদে আহমাদে সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, এক ইহুদি ব্যক্তি নবী (সা.) কে যবের রুটি ও বাসি চর্বি খাওয়ার দাওয়াত দেয়। রাসূল (সা.) সে দাওয়াত গ্রহণ করেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মহান চিত্রগুলো আমাদের সামনে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। পরিষ্কার করে দেয় ইসলাম কিভাবে শত্রুদের শান্তি-সম্প্রীতির দিকে ডাকে, যতক্ষণ না তারা যুদ্ধ বা সীমালঙ্ঘনে না জড়ায়। সেটি তাদের প্রতি ইনসাফ ও ন্যায় প্রদর্শনের মাধ্যমে। তাদের সঙ্গে উপকারী মনোভাব ও প্রতিবেশী হিসেবে সম্মান প্রদর্শের মাধ্যমে। তাদের ধর্মের প্রতি তোষামোদি দেখানো ছাড়া তাদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ ও উপহার কবুলের মাধ্যমে। সাহাবায়ে কেরামও (রা.) এ শিক্ষা বাস্তবায়ন করেছেন। তারা তাদের মোশরেক আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। তাদের হেদায়েতের আশায় তাদের সঙ্গে সদাচার করতেন। বোখারিতে বর্ণিত হয়েছে, ‘ওমর (রা.) মক্কায় এক মোশরেক ভাইকে এক জোড়া কাপড় উপহার দেন।’

আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমার কাছে আমার মাতা এলেন, তখন তিনি মোশরেক (মুসলিম হননি)। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমার বাসায় আমার মা এসেছেন। তিনি আমার সদাচার প্রত্যাশী। আমি কি তার সঙ্গে সুসম্পর্ক দেখাবো? নবীজি (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, তার সঙ্গে সুসম্পর্কসুলভ আচরণ করবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)। সুনান তিরমিজিতে সহিহ সনদে আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) এর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। একদিন তার ঘরে একটি বকরি জবাই করা হলো। খাবার রান্না হলে তিনি তার গোলামকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের ইহুদি প্রতিবেশীকে কি এ খাবার দিয়েছ? আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, ‘প্রতিবেশীর বিষয়ে জিবরিল আমাকে এত উপদেশ দিচ্ছিলেন, আমি মনে করছিলাম, তিনি হয়তো তাদের ওয়ারিশই বানিয়ে দেবেন।’

শান্তি ও সালাম বাস্তবায়নেই পরস্পর ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা ছড়ায়। এর মাধ্যমেই উন্নতি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা পায়, যা সব জাতিরই কাম্য তার দেশের জন্য। বস্তুত সামাজিক কোনো অনুষঙ্গই ঠিক হয় না শান্তি বাস্তবায়ন ছাড়া। এ কারণেই ইসলাম মানুষের পাঁচ মৌলিক চাহিদা পূরণ ও বাস্তবায়ন ওয়াজিব করেছে। সেগুলো হলো ধর্ম, জীবন, বিবেক, সম্পদ ও বংশ। কেননা প্রতিটি মানব প্রাণই সম্মানিত ও সম্মানযোগ্য। ‘নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদের স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদের অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সূরা ইসরা : ৭০)।

বোখারিতে বর্ণিত হয়েছে, নবী (সা.) এর পাশ দিয়ে একদিন একটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তা দেখে রাসুলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে গেলেন। আমরা তাঁকে বললাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! এ তো এক ইহুদির লাশ!’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এটা একটি প্রাণ নয়?’ তেমনি কোরআনে কারিম বলছে : ‘আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদ-স্থাপন করব। সুতরাং কোনো প্রাণের প্রতি জুলুম হবে না।’ (সূরা আম্বিয়া : ৪৭)। এই হলো ইসলাম। এটি উদারতা ও শান্তির ধর্ম। মমতা ও কোমলতার ধর্ম। এর আগমন ভালোবাসা ও সম্প্রীতি ছড়াতে। মানুষকে এক কাতারে আনতে এবং ঐক্য বাস্তবায়ন করতে। সুন্দর সমাজ গড়তে যার থাকবে মহত্তর বার্তা। শান্তি বা সালাম এর বিশ্বাস ও ধর্ম। এর আচরণ এবং পথ ও পন্থা।

১৫ রজব ১৪৪০ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর